ইসলামের পারবারিক জীবন গঠেনের উদ্দেশ্য
ইসলামের দৃষ্টিতে পরিবার গঠনের মূল উদ্দেশ্য জৈবিক চাহিদা তথা
যৌন প্রয়োজন ও প্রবণতাকে চরিতার্থ করাই নয়। বরং ইসলামের আলোকে বিবাহপূর্বক যৌনতা নিবারণ
হচ্ছে বৈবাহিক (দাম্পত্য) জীবনের একটি একান্ত সাধারণ ও স্বাভাবিক বিষয়। বস্তুত দাম্পত্য
ও পারিবারিক জীবনের রয়েছে আরো মহৎ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। পারিবারিক জীবন যাপনের মুখ্যতম
লক্ষ্য স্ত্রী-পুরুষের যৌনজীবনে পরম শান্তি পারস্পরিক অকৃত্রিম নির্ভরতা, উভয়ের মনে
স্থায়ী শান্তি ও পরিতৃপ্তি লাভ। কিন্তু এ-কথাই চুড়ান্ত নয়, বরং বংশসৃষ্টি, সদ্যজাত শিশু-সন্তানদের
আশ্রয়দান, তাদের সুষ্ঠু লালন-পালন ইত্যাদি এর বৃহত্তর লক্ষ্যের অন্যতম। মানব সন্তানের জীবন
হয়তবা পারিবারিক জীবন ছাড়াও সম্ভব, কিন্তু তার পবিত্রতা বিধান, লালন-পালন-সংরক্ষণ ও ভবিষ্যত
সমাজের উপযুক্ত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা পারিবারিক জীবন ছাড়া আদৌ সম্ভব নয়। এ-বিষয়টি
আল-কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতে প্রতিভাত হয়। মহান আল্লাহ বলেন- “হে মানব জাতি, তোমরা তোমাদের
সে মহান প্রতিপালককে ভয় কর; যিনি তোমাদেরকে একটি প্রাণী থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং সৃষ্টি করেছেন
তার থেকে তার জুটিকে। এবং এ দু’জন থেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন বহুসংখ্যক পুরুষ ও স্ত্রীলোক।”(সুরা আন-নিসা-১) এ আয়াতটিতে
নর-নারী স্বামী-স্ত্রী হিসেবে পারিবারিক জীবন যাপন ও এর উদ্দেশ্য সন্তানের জন্মদানের
বিষয়টি স্পষ্ট বুঝা যায়। মানবজাতির আদি পিতা আদম আ.কে সৃষ্টির পরেই তাঁর জুঁটি হিসেবে
নারী আদিমাতা হাওয়া আ.-এর সৃষ্টির বিষয়টি একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। এজোড়া-যুগলের মাধ্যমে
সমসংখ্যক কন্যাসন্তান ও পুত্রসন্তান রীতিমত
হিসেব করে সৃষ্টি করা হয়েছিল, যাতে আদম আ. এর সন্তানদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক ও পরিবার গঠনে
সংখ্যার তারতম্যের কারণে কোন অসুবিধা সৃষ্টি না-হয়। বিবাহের উদ্দেশ্যযে সন্তান জন্মদানের
মাধ্যমে মানব সৃষ্টির ক্রমধারা সংরক্ষণ করা,
তা আল-কুর‘আনের নিম্নোক্ত
আয়াতটি দ্বারাও বুঝা যায়। মহান আল্লাহ বলেন-
“তোমাদের স্ত্রীরা তোমাদের ক্ষেত স্বরূপ।
অতএব, তোমরা তোমাদের ক্ষেতে গমন কর; যেভাবে তোমরা চাও এবং তোমাদের
ভবিষ্যত রচনায় ব্যবস্থা গ্রহণ কর।”(সুরা আল-বাকারা: ২২৩) জাবির আল-জাযাইরী বিবাহের উদ্দেশ্যসমুহ বর্ণনা করেন: মানব প্রজন্মের
ধারাবাহিকতা রক্ষা, যৌনজীবনের স্বাভাবিক দাবি পূরণের মাধ্যমে নরনারীর এজীবনের পবিত্রতা
রক্ষা করা, জন্মজাত সন্তানের
রক্ষণাবেক্ষণ ও শিক্ষা-প্রশিক্ষণের পারস্পরিক সাহায্য করা, পারস্পরিক
দায়িত্ব-কর্তব্য পালনের মাধ্যমে নর-নারীর মধ্যকার সম্মান-ভালবাসার সম্পর্ক
সুসংহত করা।
এছাড়াও ইসলাম ভ্রুণহত্যা, ’আযল’ (জন্মনিয়ন্ত্রণ)
ও অযথা জন্মনিয়ন্ত্রণকে স্পষ্ট ভাষায় হারাম করার মাধ্যমে এবিষয়টিকে বুঝানোর চেষ্টা
করেছে যে, বৈবাহিক মূল উদ্দেশ্য বিশেষ কার্য সম্পন্নই নয় বরং এর অন্যতম
উদ্দেশ্য হচ্ছে, সন্তান জন্মদানের মাধ্যমে মানবজাতির বংশধারাকে অব্যাহত রাখা।
‘আযল’ (জন্মনিয়ন্ত্রণ) সম্পর্কে রাসূল স. কে জিজ্ঞাসা করা হলে, তিনি বলেন-”তোমাদের এ-কাজ
না-করাই কর্তব্য।”(সহীহুল-বুখারী,
হা. ২০৭৭ ) শারীরিক বা একান্ত ব্যক্তিগত
বিশেষ কারণ ব্যতিরেকে গর্ভরোধ, গর্ভপাত, ভ্রুণহত্যা ইত্যাদি সম্পূর্ণ অনৈতিক ও অমানবিক বিষয়। এটা এজন্যই
অবাঞ্চিত কাজ যে, এতে পিতামাতাই সন্তানের জন্য জান-জীবনের হত্যাকারী পরিগণিত হয়।
ভ্রুণহত্যা ও গর্ভপাত মানবহত্যার শামিল। নিরপরাধ নরহত্যার শাস্তি হিসেবে আল-কুর’আনে জাহান্নামকে
চিরস্থায়ী করেছে। মহান আল্লাহ বলেন-
“দারিদ্র্যের ভয়ে তোমরা তোমাদের সন্তানদেরকে
হত্যা কর না। নিশ্চয় তাদেরকে হত্যা করা একটি বিরাট (অন্যায়-অপরাধ) ভুল। আমিই তোমাদের
ও তাদের রিযক দান করি।” (সূরা-বনী ইসরাঈল: ৩১) মহানবী স. বলেন “কোনো ব্যক্তি
ততক্ষণ পর্যন্ত ইসলামের গন্ডির ভিতরে থাকে;
যতক্ষন পর্যন্ত সে ব্যক্তি নিরাপরাধ নরহত্যা না-করে।” (সাহীহুল-বুখারী
হা. ৬৩৫৫) মহান আল্লাহ বলেন- “যখন নিহত কন্যাসন্তানকে জিজ্ঞেস
করা হবে, কী অপরাধে তাকে হত্যা করা হয়েছিল?” (সূরা আত-তাকভীর-
৮ ও ৯) বর্তমান বিশ্বে গর্ভধারণ ও সন্তান জন্মদানকে বিভিন্নভাবে নিরূৎসাহিত করা হচ্ছে।
এটা মানবজাতির জন্য সবচেয়ে বিপদজনক। এজন্য নারী-পুরুষের নানান ধরনের দুরারোগ্য
জটিল রোগ সৃষ্টি হচ্ছে। এব্যাপারে সংক্ষেপে বলা যায়, পারিবারিক জীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য শুধুমাত্র বিশেষ প্রবৃত্তিকে চরিতার্থ করাই নয় বরং
এর বৃহত্তর উদ্দেশ্য সন্তান লাভ ও উপযুক্ত লালন-পালনের মাধ্যমে তাদের উপযুক্ত
মানুষরূপে গড়ে তোলা। “সন্তান-সন্তুতি আল্লাহ প্রদত্ত নিয়ামত । বস্তুত স্বামী-স্ত্রীর আবেগ-উচ্ছাসপূর্ণ প্রেম-ভালোবাসার পরিপূর্ণতা লাভ করে সন্তান জন্মলাভের মাধ্যমে। সন্তান
দাম্পত্যজীবনের নিস্কলংক পুষ্প।” সন্তানাদির ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন-“ধনসম্পদ ও
সন্তান-সন্তুতি পার্থিব জীবনে সৌন্দর্য্য ও সুখশান্তির উপাদান ।”(সুরাহ আল-কাহফ:
৪৬) আল-আলুসী রহ. তার তাফসীর গ্রন্থে এ-আয়াতটির ব্যাখ্যায় বলেন-“ধনসম্পদ প্রাণরক্ষার উপায়, আর সন্তানাদি
বংশধারা তথা মানবজাতির ধারাবাহিকতা রক্ষার উপায়।” দাম্পত্য (পারিবারিক) জীবনের
আরেকটি প্রধান লক্ষ্য চরিত্র ও নৈতিকতার সংরক্ষণ। বিবাহের মাধ্যমে ব্যক্তিচরিত্র সর্বপ্রকার
অশ্লীলতা ও নির্লজ্জতার বিপর্যয় থেকে রক্ষা পায়। আল-কুর’আনে বিবাহকে
দূর্গ (হিছ্ন) হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বিবাহের এ-উদ্দেশ্যটি উল্লেখপূর্বক
বলেন-”এ মুহরিম স্ত্রীলোকদের ব্যতীত অন্যসব মহিলা তোমাদের জন্য হালাল
করা হয়েছে, তোমরা নিজেদের ধনসম্পদ দ্বারা তাদেরকে অর্জন করার প্রত্যাশা
কর। তাদেরকে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করার জন্য এবং অবাধ যৌনচর্চার প্রতিরোধের জন্য এব্যবস্থা
করা হয়েছে। অতএব, তোমরা তাদের থেকে যে স্বাদ আস্বাদন করছ; তার বিনিময়
চুক্তি অনুযায়ী তাদের মোহর পরিশোধ কর।”
(সুরা আন্-নিসা: ২৪) এআয়াত দ্বারা বুঝা
যায়, দাম্পত্য জীবনের অন্যতম গুরূত্বপূর্ণ লক্ষ্য চরিত্র ও সতীত্বের
সংরক্ষণ করা। এবিষয়টি হাদীসে আরো স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। বিবাহের নির্দেশ, এর ফলাফল
ও উদ্দেশ্য বর্ণনাপূর্বক মহানবী স. বলেন-“বিয়ে দৃষ্টিনিয়ন্ত্রণকারী ও বিশেষ অঙ্গের পবিত্রতা রক্ষাকারী।” (সুনানুত-তিরমিযী, হা. ১০০১)
মানবজাতির জন্য লজ্জাজনক বিষয় হচ্ছে,
কতিপয় ব্যক্তি নিজেদেরকে সভ্য মনে করে
বিবাহ প্রথা ও পারিবারিক জীবনকে একদিকে যেমন গুরুত্বহীন মনে করে, অন্যদিকে
দাম্পত্যজীবনকে শুধুমাত্র বিশেষ কার্য সম্পন্নকরণ বা নিছক আনন্দ উপভোগ করার মাধ্যম
ও পদ্ধতি মনে করে থাকে। প্রকৃত বিচারে বিবাহ,
দাম্পত্যজীবন গঠনের উদ্দেশ্য হচ্ছে নর-নারীর
মধ্যে ভালবাসা ও সম্প্রীতি সৃষ্টির পাশাপাশি ব্যক্তিচরিত্র ও সতীত্ব রক্ষাসহ মানবজাতির
ধারাবাহিকতা রক্ষার তাগিদে সন্তান জন্মদান ও জন্মজাত সন্তানের লালন-পালনের একটি স্থায়ী
ও কার্যকর ব্যবস্থা। বিয়ের উদ্দেশ্য বর্ণনায় কোনো একজন মুসলিম মনীষী বলেছেন, নারী-পুরুষের
বিশেষ কামনা চরিতার্থ করার পন্থাকে বিধিবদ্ধ করা ও বিশেষ উচ্ছৃংখলতা থেকে পবিত্র রাখা, নারী-পুরুষের
প্রাকৃতিক প্রেমপ্রীতি ও ভালবাসার দাবিকে পূত পন্থায় পূর্ণকরা এবং তার সহজাত এসব দাবিকে
বিকশিত ও পূর্ণতা দান, পরিবার গঠন, বংশবিস্তার ইত্যাদি ।
অধ্যাপক, ইবি, কুষ্টিয়া
মোবাইল ০১৭১৮৬৯৫৭৫৩
ই-মেইল ikbalabunaeem@gmail.com
0 মন্তব্যসমূহ