ইসলামে পারিবারিক জীবনের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা
বিবাহ ও বৈবাহিক সম্পর্ক মানবজাতির শ্রেষ্ঠত্বের একটি বড় প্রমাণ। এ-শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ-প্রকাশের প্রয়োজনে পরিবার ও পাবিরাবিক জীবনগঠন খুবই জরুরী ও গুরুত্বপূর্ণ। এজন্যে পরিবারগঠন বিষয়ে ইসলাম যথেষ্ঠ গুরুত্বারোপ করে। আল্লাহর নাযিলকৃত সকল গ্রন্থ ও সকল নবী-রাসূল এ ব্যাপারে যথেষ্ট গুরুত্ব প্রদান করেছেন। নবী-রাসূলগণ বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে সাংসারিক জীবনযাপন করতেন। তাঁদের ঘরসংসার ও পরিবার-পরিজন ছিল। তাঁদের এ-বৈবাহিক সম্পর্ক সৃষ্টি শুরু সংসার সৃষ্টির প্রয়োজনেই ছিল না বরং এটা ছিল তাঁদের মানবীয় প্রকৃতি ও চিরায়ত বিধানের ফলশ্রুতি। পরিবার সৃষ্টির মাধ্যমেই মানবজাতির সামাজিক জীবনের সূচনা হয়। মানুষ তার জীবনের শূন্যতা ও অসম্পূর্ণতা দূর করতেই পরিবার ও পারিবারিক জীবনগঠনে বাধ্য হয়।
বর্তমান বিশ্বে বস্তুবাদী ও অস্বাভাবিক সভ্যতাসমূহ দাম্পত্য জীবন ও সংসার গঠনকে অনেকটা অপ্রয়োজনীয় ও গুরুত্বহীন বিষয় মনে করে। মনুষত্ব ও মানবতা-বিরোধী এসব অসার চিন্তাদর্শন পরিবার সৃষ্টির গুরুত্বকে খাঁটো করে দেখার মাধ্যমে পক্ষান্তরে মানবতা ও মনুষত্ব্যের একটি অনিবার্য-অপরিহার্য বিষয়কেই অস্বীকার করে। এসব দর্শন স্বামী-স্ত্রী, স্ত্রী-স্বামী, পুত্র-পিতা, পিতা-পুত্র, ভাই-বোন, বোন-ভাইয়ের প্রতি কোনো প্রকার দয়া-দরদ অনূভব করে না। ফলে সমাজ জীবনের যে ভাঙন দেখা দিয়েছে, তা শুধু সভ্যতাকেই ধ্বংস করছে না বরং মনুষত্ব ও মানবতাকেই ধ্বংস করছে। বারট্রান্ড রাসেলসহ অনেক বিভ্রান্ত বস্তুবাদি চিন্তাবিদ পারিবারিক জীবনগঠনের বিরুদ্ধে অজ্ঞতা প্রসূত যেসব খোঁড়াযুক্তি দাঁড় করায়; তা সম্পূর্ণভাবেই অর্থহীন ও অন্তঃসারশূন্য। বস্তুত বিবাহ ও পরিবারগঠনের চলমান এধারা-প্রবাহ বন্ধ হলে, মানবজীবনে চরম উচ্ছৃংখলতা, বিপর্যয় ও নৈরাজ্যের সৃষ্টি হবে, এবং তা অত্যন্ত মারাত্বক ও ধ্বংসাত্বক পথে প্রবাহিত হতে থাকবে। এর স্বভাব সম্মত প্রবাহ পথ উম্মুক্ত না-থাকলে এর অনিবার্য ফলশ্রুতিতে মানসিক বিপর্যয় সৃষ্টি হবে এবং গোটা সমাজব্যবস্থা ভেঙ্গে চূর্ণ-বিচুর্ণ হয়ে যাবে। দাম্পত্য ও পারিবারিক জীবনের এসব গুরুত্ব অনুধাবণ করেই ইসলাম বিবাহ ও পারিবারিক জীবনগঠনকে বিধিবদ্ধ করেছে এবং বিবাহে সক্ষম ব্যক্তিক্ষেত্রে বিবাহ-বিরাগ হওয়া নিষিদ্ধ করেছে। সর্বোপরি, এ-ব্যাপারে উৎসাহ প্রদানপূর্বক প্রয়োজনীয় বিধিবিধান নির্দেশ করেছেন। বিবাহের বৈধতা, বিধিবদ্ধতা, এর প্রতি নির্দেশ ও উৎসাহ প্রদানপূর্বক মহান আল্লাহ বলেন “তোমাদের মধ্যে বিবাহহীনদের বিবাহ সম্পন্ন করো এবং তোমাদের দাসদাসীদের মধ্যে যারা সৎকর্মপরায়ণ তাদেরও। তারা নিঃস্ব হলে, আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে সচ্ছল করে দিবেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময় ও সর্বজ্ঞ।” (সুরা আন-নূর :৩২) মহান আল্লাহ আরো বলেন, “যদি তোমরা ভয় কর যে, এতিম মেয়েদের অধিকার যথাযথ পূরণ করতে পারবে না, তবে সেসব মেয়ের মধ্য থেকে যাদেরকে তোমাদের ভাললাগে; তাদের বিয়ে করো দু-দু’টি, তিন-তিনটি, চার-চারটি পর্যন্ত যদি এরূপ আশংকা করো যে, তাদের মধ্যে ন্যায়সংগত আচরণ বজায় রাখতে সক্ষম হবে না, তাহলে (তাদের) একজনকেই বিবাহ করবে।”(সুরা আন্-নিসা-৩) মহান আল্লাহ আরো বলেন, “...এদের ছাড়া তোমাদের জন্য অন্যসব নারী বৈধ করা হল। তবে, তোমরা তাদেরকে অর্থের বিনিময়ে বিবাহের জন্য তালাশ করবে ব্যাভিচারের জন্য নয়।”(সুরা আন-নিসা-২৪) মহান আল্লাহ আরো বলেন, “আল্লাহ তোমাদের নিজেদের থেকে তোমাদের জোড়া সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদের জন্য তোমাদের জোড়া থেকে সন্তান-সন্তুতি সৃষ্টি করেছেন।”(সুরা আন-নহল-৭২) মহান আল্লাহ আরো বলেন, “একটি নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের জোড়া-যুগল সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তিতে থাক এবং তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক সপ্রীতি ও অনুগ্রহ সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয়ই এতে চিন্তাশীলদের জন্য নিদর্শন রয়েছে।”(সুরা আর রুম-২১) এ-ব্যাপারে আল্লাহ কুরআনুল কারীমে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে আরো আয়াত থাকলেও সবগুলো এখানে উল্লেখ করা হয়নি। কেননা, দলীল-প্রমাণ হিসেবে কুরআনের একটি আয়াতই যথেষ্ট।
উপরিউক্ত আয়াতসমুহের পাশাপাশি মহানবী স.-এর এ প্রাসঙ্গিক হাদীসও উল্লখ করা প্রয়োজন। কারণ, হাদীস ইসলামের বাস্তব রূপ এবং ইসলামী শরীয়া-এর দ্বিতীয় প্রধান উৎস। প্রাসঙ্গিক বিষয়ে বহুসংখ্যক হাদীসের কয়েকটি নিম্নরূপ:
“চারটি কাজ নবীগণের আদর্শের অন্তর্ভুক্ত: আতর (সুগন্ধি), বিয়ে, মিসওয়াক ও খাতনা।”(সুনানুত-তিরমিযী, কিতাবুন্নিকাহ, হা., ১০০০, মুসনাদু আহমদ, হা. ২২৪৭৮) “হে যুবসমাজ, তোমাদের মধ্যে যারা বিবাহের সামর্থ রাখে; তারা বিবাহ করো।”(সহীহুল-বুখারী, হা. ৪৬৭৭) “কুমারিত্ব (অবিবাহিত) জীবন যাপনের বিধান ইসলামে নেই।”(সুনানু আবু দাউদ, হা.১৪৬৯ ) “যে ব্যক্তি সামর্থ থাকা সত্তে¡ও বিয়ে করে না; সেব্যক্তি আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়।”(সুনানুদ-দারিমী, হা. ২০৭০) “তোমরা স্নেহপরায়ণ ... মেয়েদেরকে বিবাহ কর। ”(মুসনাদু আহমদ, খ. ৩, পৃ. ১৫৮) “আমি বিবাহ করি। যেব্যক্তি আমার সুন্নাতে অনাগ্রহ প্রকাশ করবে; সেব্যক্তি আমার দলভুক্ত নয়।”(সাহীহুল-বুখারী, কিতাবুন্নিকাহ, হা. ৪৬৭৫) ইসলামে বৈবাহিক-পারিবারিক জীবনের গুরুত্ব কতখানি; তা উপরিউক্ত কুরআন ও হাদীসের আলোচনা থেকে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়। ইসলামের দৃষ্টিতে বিবাহ ও পারিবারিক জীবন যাপন করা সাধারণ বা ঐচ্ছিক কোনো বিষয় নয়। বরং এটি মহান আল্লাহর এক সুস্পষ্ট নির্দেশ। ইসলামের দৃষ্টিতে বিবাহ জাগতিক বিষয় নয়, বরং ইবাদত।
পরিবারগঠন ও পারিবারিক জীবনব্যবস্থার গুরুত্ব-প্রয়োজনীয়তা বর্ণনার পাশাপাশি প্রাসঙ্গিকতার কারণে পরিবারপ্রথা বিলুপ্তির কুফল সম্পর্কে আলোচনা করা যায়। ইসলামের শত্রুগণ এর ক্ষতির উদ্দেশ্যে সবচেয়ে বড় যে-হাতিয়ার গ্রহণ করেছে তা হচ্ছে; বিবাহ ও পরিবারপ্রথা বিলুপ্তির আত্মঘাতি কর্মসূচি। তাদের এঅন্যায় চিন্তাদর্শন সমগ্র মানবজাতির জন্য ধ্বংসাত্বক। বৈধ বিবাহের মাধ্যমে গঠিত পরিবার প্রথা ধ্বংসের দ্বারা মানবজীবনে নিম্নোক্ত ক্ষতি ও অশান্তি নেমে আসে। যেমন: দাম্পত্য জীবনের মাধুর্যতা বিনষ্ট হয়ে যৌন জীবনে উচ্ছৃংখলতা নেমে আসে, প্রেমপ্রীতি, স্নেহ-ভালোবাসা, দয়ামায়া, বদান্যতা ও সহানুভূতি দুরীভূত হয়, সন্তানলাভ থেকে বঞ্চিত হয়ে বংশধারা ও আত্মীয়তার সম্পর্ক বিলুপ্ত হয়, পিতামাতা ও সন্তান-সন্তুতির অধিকার বিনষ্ট হয়, সমাজে আদর্শিক ঐতিহ্য ও মানবিক মূল্যবোধ বিনষ্ট হয়, নারীরা কঠোর শ্রমে অংশগ্রহণে বাধ্য হয়। মহান আল্লাহ মানবজাতিকে এ ভয়াবহ বিপর্যয় থেকে রক্ষা করুন।
ইকবাল আবু নাঈম
অধ্যাপক, ইবি, কুষ্টিয়া
মোবাইল ০১৭১৮৬৯৫৭৫৩
ই-মেল: ikbalabunaeem@gmail.com
0 মন্তব্যসমূহ